তখন প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি। মগবাজারে বাসা। তবুও স্বাধীনভাবে চলতে, ঘোরতে, ক্যাম্পাসের স্বাদ পুরোপুরি পেতে আবাসিক হলে গিয়ে থাকা শুরু করেছি। তাও আবার রণাঙ্গন হিসাবে খেতাব পাওয়া সূর্যসেন হলে। অনেকগুলি বন্ধু মিলে আমরা তিন তলার উত্তর ব্লকে থাকি আর মনের আনন্দে নাচানাচি করি। বন্ধুরা সবাই মিছিল মিটিং করে। দেখাদেখি আমিও করি। মজাই মজা।
রণাঙ্গন কি আর সাধে বলত নাকি ! হলটা ছিল ইজরায়েল আর প্যালেস্টাইনের ‘গাজা’ নিয়ে কাড়াকাড়ির মতন অবস্থায়। তখন ছাত্রদল, ছাত্রলীগ, জাসদ, বাসদ সব দলই ক্যাম্পাসে স্ট্রং। কেউ কারো চেয়ে কম যায় না শক্তিতে। হলগুলির একেকটা কোন কোন দলের একচেটিয়া স্ট্রং হোল্ড হলেও একমাত্র সূর্যসেনে কোন দলের একচ্ছত্র আধিপত্য চলত না। ওখানে সবাই রাজা। তাই যখন তখন ধুম ধুম করে যুদ্ধ লেগে যেত। রুম ভাঙ্গাভাঙ্গি হত। ফাঁকা গোলাগুলি চলত। আবার শান্তি পতাকা তুলে সন্ধি করে সহাবস্থান চলত। মারামারি হলেও কেউ কাউকে খুন করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠত না। খুব বেশী বাড়াবাড়ি হলে আগে খবর পাঠিয়ে দিয়ে বলত – তোরা হল ছেড়ে আপাতত ভাগ। আমরা এটাক করতে আসতেছি। – ব্যস এইটুকুই।
তিন তলার উত্তর ব্লকে ছাত্রদলের বন্ধুরা ছাড়াও থাকত ছাত্রলীগের আবদুস সোবহান গোলাপ ভাই ( ভিপি ), ছাত্রলীগের হেলাল ভাই ( এজিএস) , ছাত্রলীগের সেলিম ভাই (পরে পুলিশের গুলিতে নিহত ), বাসদের জিয়াউদ্দিন বাবলু ভাই (ডাকসু জিএস)। যে যার মত আলাদা দল করত কিন্তু হলের ক্যাফেটেরিয়া, ক্যান্টিন, বাথরুম তো কমন ছিল। কমন ছিল টিভি রুম।
বাবলু ভাইয়ের মুদ্রা দোষ ছিল, দেখা হলেই জিগ্যেস করত – ‘ভাল আছো ?’
দিনে বিশবার দেখা হলে বিশ বারই এই কথা জিজ্ঞেস করতো এবং সেটা যে কোন পরিবেশে।
বলেছি উত্তর ব্লকে আমরা সবাই সেইম কমন টয়লেট ইউজ করতাম। একদিন আমার রুমমেট ডালিম দেখল কেউ একজন একটা টয়লেট ইউজ করে পানি ঢালে নাই। তার মাথায় ভুত চাপল। সে টয়লেটের সামনে দাঁড়িয়ে পাহারা দেয়ার সিদ্ধান্ত নিল। কে পানি ঢালে না সেই কাল্প্রিটকে পাকড়াবে। একটু পর লুঙ্গি পরা বাবলু ভাই এল বদনা হাতে নিয়ে। ডালিমকে দেখে যথারীতি জিজ্ঞেস করল ওনার পেটেন্ট করা প্রশ্ন। অন্য সময় ‘ভাল আছি’ উত্তর দিলেও সেদিন ডালিম ক্ষেপে ছিল। তাই উত্তর দিল – ‘না, ভাল নাই। কালপ্রিট ধরার জন্য দাঁড়ায়ে আছি। দেখবো কোন বেটা হেগে পানি ঢালে না। তাকে ধরে সব খাওয়ায়ে দিব।’ ডালিমের মারমুখো অবস্থা দেখে বাবলু ভাই রীতিমত ভয় পেয়ে উল্টা হাঁটা ধরেছিল সেদিন। এই ব্যাপারটা নিয়ে পরে আমরা অনেকদিন বেশ হাসাহাসি করেছি।
জাসদ ভেঙ্গে বাসদ হলে জাসদের ছেলেরা বাবলু ভাইকে পেটাতে এলে এই ডালিম সেদিন ওনার রুমের সামনে হকিস্টিক হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে বাবলু ভাইক মাইরের হাত থেকে বাঁচিয়েছে। এসব কারণে ভিন্ন দল করি জেনেও তিনি আমাদেরকে অনেক স্নেহ করতেন।
গোলাপ ভাই ছাত্রলীগ থেকে ভিপি হলেও আমাদের সাথে আপনা ভাইয়ের মত সম্পর্ক ছিল। কারণ কি জানেন ! হলে আমরা শ’খানেক ছেলে ছিলাম ‘তুই’ সম্পর্কের।এদের কাছে দলের চেয়ে বন্ধুত্ব অনেক বড় ব্যাপার ছিল। এরা দলের চেয়ে হলের যোগ্য মানুষটাকে নির্বাচিত করতে মাঠে নামত। তাই সবাই আমাদেরকে কাউন্ট করত।
এছাড়া হলের ভিন্ন ভিন্ন দলের জুনিয়র সিনিয়রদের ভিতর ছিল অদ্ভুত সুন্দর স্নেহ এবং শ্রদ্ধার সম্পর্ক। সবার ঊর্ধ্বে চিন্তা থাকত আমরা সবাই ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্র। তারমানে সবাই এক পরিবারের মানুষ। এই অনুভূতিটা প্রবল ছিল। নইলে কি আর বান্ধবীকে দেয়ার জন্য একটা ফুল ছেঁড়ার অপরাধে রমনা পার্কের মালীরা এক ছাত্রকে কোপালে মধুর ক্যান্টিন থেকে ১৫/২০ টা মোটরসাইকেল বোঝাই ছাত্ররা গিয়ে বন বিভাগের অফিসারকে ধরে এনে আহত ছাত্রের চিকিৎসার সব খরচ আদায় করে দিত নাকি !
শহীদুল্লাহ হলের সাথে সূর্যসেন হলের ফুটবল খেলা চলছে। খবর এসেছে ওরা আমাদের হলের জিএস ( ছাত্রদল) খোকনের পায়ে আঘাত করে লুলা বানিয়ে দিয়েছে।সে স্ট্রাইকার কিন্তু ব্যথার জন্য খেলতে পারতেছে না। ছাত্রলীগের সেলিম ভাই সেদিন টেম্পু ভর্তি করে আধলা ইট নিয়ে পাগলা ঘণ্টি বাজিয়ে হলের সব পোলাপান সাথে নিয়ে সত্যিকারের সূর্যসেনের মত নেতৃত্ব দিয়ে নিজ হলের আহত জিএসকে উদ্ধার করে তাকে আঘাত করার প্রতিশোধ নিতে গিয়েছিল। তখন কোন দলীয় চিন্তা মাথায় ছিল না। তখন সবাই সূর্যসেনের বাসিন্দা।
আমি নিজেই তো একবার রিকশাওয়ালাকে থাপ্পড় দিয়ে ওদের হাতে জিম্মি হয়ে আটকা পড়ে গেছিলাম। কোনমতে একটা ফোন করে মধুর ক্যান্টিনে খবরটা পৌঁছাতে পেরেছি। ব্যস, আবার সেই ১৫/২০ মোটরসাইকেল বোঝাই ছাত্ররা এসে আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে গেল। তাদের বেশীরভাগকেই আমি পারসোনালি চিনতাম না।
তখন ছাত্রদের ভিতর এমন একতা ছিল বলেই ডাকসু শক্তিশালী ছিল। কেন শক্তিশালী ছিল জানেন ? দল করতাম একটা, কিন্তু ডাকসুর ভিপি জিএস নির্বাচনের বেলায় সবাই ভোট দিতাম সবচেয়ে জনপ্রিয় যোগ্য মানুষদেরকে। শুধু দলীয় ভাবনায় কোন এদ্রু পেদ্রু মানুষ ডাকসুর ভিপি/জিএস নির্বাচিত হতে পারত না। ছাত্ররা সেই ভুল করত না। তাই ডাকসু শক্তিশালী ছিল। ডাকসু ডাক দিলে সব ছাত্র এক হয়ে যেত। কোন আলাদা দলের ব্যানার থাকত না।
ডাকসুকে দেশের যে কোন সরকার বাঘের মত ভয় পেত। তার নমুনা তো দেখলেন সবাই – এই ডাকসুর কারণে ছাত্ররা এক হয়ে গিয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ বানিয়ে সেনাপতি এরশাদের দুর্গ চুরমার করে দিয়ে তাকে তার মসনদ থেকে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে ফেলেছে। সেটা আর কেউ নয় – শুধু ঢাকা ইউনিভার্সিটির একতাবদ্ধ ছাত্ররাই পেরেছে।
ডাকসুকে ভয় পেত বলেই এতোগুলি বছর কোন সরকার ডাকসু নির্বাচন হতে দেয় নাই। তাদের মনে অন্যায় করে ক্ষমতায় টিকে থাকা নিয়ে মারাত্বক ভীতি ছিল। বর্তমান সরকার দশ বছর রাজত্ব করে ইউনিভার্সিটির ভিন্ন মতের ছাত্রদেরকে সব হল ছাড়া করে তারপর প্রহসনের নির্বাচন দিল। এই নির্বাচনে ভোট চুরি না করলেও ছাত্রলীগ জিতে যেত। তবুও তাদের মনে অলীক ভীতি কাজ করেছে। তাই আগের রাতে ব্যালট বক্স পুরে রেখেছে।
কলঙ্কিত করে দিল ঢাকা ইউনিভার্সিটির সার্বভৌমত্ব। ভুলুন্টিত হল ছাত্রদের গর্বের ইতিহাস।এখন কোথাও কোন ছাত্র মার খেলে, খুন হলেও কেউ এগিয়ে আসে না। আসবে না। এখন ছেলেরা নিজেদের ক্যাম্পাসের মেয়েদের নিরাপত্তা দেয়ার চাইতে কখন কেমন করে লুকিয়ে গায়ে হাত বুলাবে সেই ধান্দায় ব্যস্ত থাকে।
ঢাকা ইউনিভার্সিটির ভিসি মানে মারাত্বক শিক্ষিত, পলিসড বিশাল অনড় এক ব্যাক্তিত্ব। সেই রকম ব্যাক্তিত্বরা এখন ইতিহাস। পুরনো ইতিহাস। এখনকার ভিসি’র কথা শুনলে কনফিউজড হয়ে যাই ভেবে ইনি কি ক্যাম্পাসের কোন পিওন নাকি অফিস ক্লার্ক। নিজের কাছেই শরম লাগে ভিসির কথাবার্তার সস্তা স্টাইল দেখে।
রাজনীতি করুক, তাতে আপত্তি নাই। কিন্তু ভিসি কেমন করে ভুলে যায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি শুধু একটা শিক্ষা প্প্রতিষ্ঠান নয় – এটি এই দেশের সৃষ্টির পেছনের ইতিহাস। এটি দেশের ন্যায়পালের মত। তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান। তাঁর ওজন অনেক বেশী। সেই ওজনদার মানুষটা এমন সস্তা কাজের জোগান দেবে এমনটা ভাবতে খুব কষ্ট লাগে।
আমার কষ্টে কার কি আসে যায় ! দেশের মানুষ তো দেশের নাগরিক না – তারা দলের গোলাম। তাই তাদের কাছে এমন নির্বাচনও অনেক আনন্দের বৈকি।
মুরাদ হাই (প্রাক্তন ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে)